নিজস্ব প্রতিবেদক:
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ৭নং খালিশা চাপানী ইউনিয়নে সেবার মান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। একসময় যাদের অভিযোগ ছিল—ইউনিয়ন পরিষদে গেলে চেয়ারম্যান বা সদস্যদের পাওয়া যায় না, প্রকল্প বণ্টনে অনিয়ম হতো, দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হতো—সেসব চিত্র এখন অনেকটাই বদলে গেছে। পরিষদের নেতৃত্ব, ডিজিটাল তথ্য প্রদান এবং জনগণের প্রতি মানবিক আচরণ এলাকাবাসীর আস্থা ফিরিয়ে এনেছে।
ডালিয়া তিস্তা বাঁধ এলাকায় বসবাসরত ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা সালেহা বেওয়া অতীতের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কাঁপা গলায় বলেন, “দিন বদলিছে, মানুষজনও সচেতন হচে। আগেকার সময় বাউ মানুষ না খায়া মরিছে, এখন আর না খায়া মরে না। ৫ বছর আগত পরিষদত যেয়া চেয়ারম্যানক কথা কবার পাই নাই। চেয়ারম্যান হামাগুলাক দামে দিবার চায়না। কিন্তু এখন আর অমন ব্যবহার করির পায়না।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান চেয়ারম্যান ডাকিলে আইসে, যখন তখন পরিষদত পাওয়া যায়। চ্যাংরালা কয়—হামার পরিষদ উন্নত হইছে। চেয়ারম্যানের ফেসবুকত সউগ তথ্য পাওয়া যায়।”
এক সময় ইউনিয়ন পরিষদে গেলে সাধারণ মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চেয়ারম্যান-মেম্বারদের পাওয়া যেত না। অভিযোগ ছিল—পরিষদের কর্মকর্তারা দায়িত্বে অনুপস্থিত থাকেন, কাজ করতে গড়িমসি করেন, আর দরিদ্র মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করেন রূঢ়ভাবে। বর্তমান চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরিষদে নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে পরিষদ খোলা থাকে। তিনি নিজেও দীর্ঘ সময় অফিসে থাকেন।
চেয়ারম্যান বলেন— “পরিষদ হচ্ছে মানুষের প্রতিষ্ঠাণ। তাই সবাই যেন নির্বিঘ্নে সেবা পায়—এটাই আমার লক্ষ্য।”
অতীতে প্রকল্প বণ্টন, ত্রাণ বিতরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অনিয়মের অভিযোগ ছিল স্বাভাবিক। সুবিধাভোগীদের তালিকা গোপন রাখা হতো, প্রকল্পের তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছাত না।
বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান সরকার তার ফেসবুক পেজে— ভিজিডি-ভিজিএফ তালিকা, ত্রাণ বিতরণ, বয়স্ক ভাতা নবায়ন, রাস্তা সংস্কার প্রকল্প, পরিষদের নোটিশ, উন্নয়ন কাজের অগ্রগতি —সবকিছু নিয়মিত প্রকাশ করেন। অনেক সময় লাইভে ত্রাণ বিতরণও দেখানো হয়।

ডালিয়া এলাকার কলেজছাত্র রাব্বি বলে— “আগে কোন প্রকল্পে কারা পেল—তা জানা যেত না। এখন লাইভ দেখে সবাই বুঝতে পারে। অনিয়মের সুযোগ নেই।”
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে পরিবর্তন—প্রকৃত দরিদ্র এখন অগ্রাধিকার: ৭নং খালিশা চাপানী ইউনিয়নে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, ভিজিডি-ভিজিএফ সহ বিভিন্ন প্রকল্প এখন যাচাই-বাছাই করে দেওয়া হচ্ছে।
সালেহা বেওয়া বলেন— “আগে ৭ বার নাম লিখাইছি—ভাতা পাই নাই। এখন একবার ডাকিছে—ভাতা পাইছি।” বিএমএস (Beneficiary Management System) অনুযায়ী তালিকা তৈরি করা হচ্ছে এবং সব তালিকা পরিষদে ঝোলানো হয়।
তিস্তা ব্যারেজ এলাকায় প্রায়ই বন্যা দেখা দেয়, নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারান অনেক মানুষ। আগে এসব বিপদে স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল—পরিষদের পক্ষ থেকে তেমন সহযোগিতা পাওয়া যেত না।
বর্তমান পরিষদ বন্যার সময় দ্রুত ত্রাণ বিতরণ, আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সহায়তা দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে বন্যাকবলিত এলাকায় বারবার ত্রাণ নিয়ে ছুটে গেছেন চেয়ারম্যান।
বৃদ্ধা সালেহা বলেন— “আগে ভাঙন লাগলে কেউ খবর লইত না। এখন চেয়ারম্যান নিজেরই আইসা দেখে। কার্ড দিয়া চাল-ডাল দিছে।”
রাস্তা-ঘাট, সেচ, কৃষি সহায়তা—ইউনিয়নে দৃশ্যমান উন্নয়ন:
সরকারের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি সড়ক নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে।
এছাড়াও—
ড্রেনেজের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরুপনে বিভিন্ন এলাকায় ড্রেন নির্মাণ, সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন, যুবকদের EGPP, FFW প্রকল্প, গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ, বিদ্যালয় ও মসজিদের সংস্কার করা হয়েছে। এসব উন্নয়নমূলক কাজগুলো এলাকাবাসীর জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

নারী ও প্রতিবন্ধী সেবায় বিশেষ গুরুত্ব: পরিষদে এখন আলাদা নারী ডেস্ক চালু করা হয়েছে। নারী সদস্যরা নিয়মিত পরিষদে উপস্থিত থেকে সেবা প্রদান করছেন।
এক মহিলা সদস্যা বলেন— “আগে নারীরা পরিষদে আসতে সংকোচ বোধ করত। এখন পরিবেশ নারী-বান্ধব। জন্ম সনদ, ভাতা—সব কাজে নারীরা সহজে সেবা পাচ্ছেন।” প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে এবং তাদের ভাতা ও হুইলচেয়ারসহ বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে।
সচেতনতার উত্থান—জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ফেসবুক পোস্ট ও লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে জনগণ পরিষদের কাজ সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক বেশি অবগত। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ, প্রশ্ন এবং নজরদারি বেড়েছে। মানুষ এখন প্রকল্পে নিজের অধিকার দাবি করতে সাহস পাচ্ছে।
৬২ বছর বয়সী কালাম উদ্দিন বলেন— “ মানুষক আগে কেউ দাম দিত না। এখন কারা আসল গরিব—তা দেখে ভাতা দিছে। একটু শান্তি হইছে।”
চেয়ারম্যান শহিদুজ্জামান সরকারের আরও বলেন— “স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা আমার দায়িত্ব। পরিষদ মানুষের। তাই সব সেবা সহজীকরণ করেছি। প্রকল্প, ত্রাণ, ভাতা—সবকিছু ওপেন করে দিয়েছি। কোন দুর্নীতি সহ্য করব না। গরিব, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, নারী—সবাই যেন সমানভাবে সেবা পায়। দলমত নির্বিশেষে সেবা দিচ্ছি। এটাই আমার অঙ্গীকার।”
৭নং খালিশা চাপানী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান কার্যক্রম সাধারণ মানুষের কাছে একটি ইতিবাচক সুশাসনের উদাহরণ হয়ে উঠেছে। অতীতে যেখানে পরিষদের দরজা ছিল বঞ্চনার প্রতীক, সেখানে এখন মানুষের আস্থা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার নতুন যুগ সূচিত হয়েছে।
