Home অপরাধ অনুসন্ধানআগুন নাকি রাজনৈতিক বাস্তবতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ?

আগুন নাকি রাজনৈতিক বাস্তবতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ?

by News Desk
0 comments

সোহেল অটল:
ঢাকার আকাশে ঘন ধোঁয়া। আগুনে লেলিহান শিখা ছুঁয়ে ফেলছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের বিশাল গুদাম এলাকা। একের পর এক বিস্ফোরণ, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা কনটেইনার, ৩৬টি ফায়ার ইউনিটের নিরলস প্রচেষ্টা—তারপরও নিয়ন্ত্রণে আসছে না আগুন। এমন দৃশ্য বাংলাদেশ আগে খুব একটা দেখেনি।
এ আগুন শুধু গুদামের নয়—এ যেন দেশের নিরাপত্তা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন। কারণ, বিমানবন্দর বাংলাদেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত ও কৌশলগত স্থাপনাগুলোর একটি। সেখানে যদি আগুন এভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে তা নিছক দুর্ঘটনা না, বরং গভীরতর কোনো পরিকল্পনার ইঙ্গিতও হতে পারে—এমন আশঙ্কা এখন অনেকের মনে।

দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা—প্রশ্নের কেন্দ্রে শাহজালাল বিমানবন্দর
আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ‘নাশকতা তত্ত্ব’ নিয়ে হাজির হওয়াকে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করার মতো লাগতে পারে। কিন্তু ‘দই ভেবে চুন খেয়ে জিহ্ববা পোড়ানোর’ অভিজ্ঞতা আমাদের অসংখ্যবার হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো দুর্ঘটনাকেই এখন আর নিছক দুর্ঘটনা মনে হয় না।

ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক তথ্যে বলা হচ্ছে, আগুন শুরু হয়েছে কার্গো ভিলেজের ভেতরের একটি গুদাম থেকে। সেখানে প্রচুর দাহ্য প্যাকেজিং সামগ্রী, কাগজ, প্লাস্টিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য মজুত ছিল। তবে, এখন পর্যন্ত আগুনের প্রকৃত উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি।

কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘তদন্তের পর জানা যাবে।’ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে— শুধু দুর্ঘটনায় কি এত বড় অগ্নিকাণ্ড সম্ভব?
শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রতি ব্যাপক আধুনিকায়ন করা হয়েছে। তৃতীয় টার্মিনাল প্রায় সম্পন্ন, নতুন অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি স্থাপন করা হয়েছে। এসব বিনিয়োগের পরও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তবে সেটি নিঃসন্দেহে এক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।
আর যদি কোনোভাবে নাশকতা ঘটে থাকে, তবে তা হবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ড: কাকতালীয় নাকি এক অদৃশ্য সংযোগ?
গত দুই সপ্তাহে বাংলাদেশজুড়ে ঘটে যাওয়া একের পর এক অগ্নিকাণ্ড এখন এক ভয়াবহ ধারা তৈরি করেছে। রাজধানী ঢাকার মিরপুরের বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ আগুনে বহু প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারও আগে চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপ নামের একটি পোশাক কারখানায় লেলিহান আগুনে বিপুল ক্ষতি হয়। এখন সেই ধারাবাহিকতার পরই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন—যা দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকায়।

এই পরপর আগুনের ঘটনাগুলোকে শুধুই দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়া কঠিন। কারণ প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে এমন জায়গায়, যেখানে নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ঘাটতি থাকার কথা নয়। তাই অনেকেই মনে করছেন—এগুলো হয়তো কোনো বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক আস্থাকে নড়বড়ে করা।
তদন্ত শুরু না হলেও, ঘটনাগুলোর মধ্যকার এই “ধারাবাহিকতা” নিঃসন্দেহে এক গভীর প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে— দেশ কি কোনো অদৃশ্য নাশকতার কবলে পড়ছে?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: এক উত্তপ্ত সময়
২০২৫ সালের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন অত্যন্ত জটিল। জাতীয় নির্বাচন সামনে, দলীয় সমীকরণ বদলে যাচ্ছে দ্রুত। রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে সক্রিয়, আর সরকারের ভেতরেও নানা দ্বন্দ্বের গুঞ্জন চলছে।
এমন সময় একটি বড় দুর্ঘটনা—বিশেষত দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক গেটওয়েতে—রাজনৈতিকভাবে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশে নাশকতা রাজনীতির নতুন কিছু নয়। অতীতে নানা সময় পরিবহন, রেললাইন, বিদ্যুৎকেন্দ্র বা বন্দর এলাকায় নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, যার উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, কিংবা রাষ্ট্রীয় মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।

তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এই আগুনও কি তেমন কোনো বার্তা বহন করছে?
যদি এমন হয়, তবে এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও একটি বড় ইঙ্গিত।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশ নিয়ে বহুমুখী স্বার্থের লড়াই
বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুতে অবস্থান করছে।
ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—এই তিন পরাশক্তিই বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান নিয়ে আগ্রহী। ভারত চায় সীমান্ত নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে। চীন চায় বন্দর ও অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক প্রবেশদ্বার হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে।

আর যুক্তরাষ্ট্র চায় ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে রাখতে।
এই তিন শক্তির সমীকরণে বাংলাদেশের বিমানবন্দর, বিশেষত শাহজালাল, একটি গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক নোড। এখানকার স্থিতিশীলতা মানে—তাদের আঞ্চলিক স্বার্থের স্থিতিশীলতা।
তাই বিমানবন্দরে এমন আগুন আন্তর্জাতিকভাবে শুধু নিরাপত্তা নয়, কূটনৈতিক কনফিডেন্সকেও নড়বড়ে করে দেয়।

দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অনিয়মের ছায়া
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর প্রতিটি বড় প্রকল্পেই দুর্নীতির অভিযোগ প্রায় নিয়মিত। বিমানবন্দরও তার ব্যতিক্রম নয়। কার্গো ভিলেজে শুল্ক ফাঁকি, ঘুষ, অবৈধ চালান, ও প্রশাসনিক সিন্ডিকেট নিয়ে বহু রিপোর্ট রয়েছে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন—যদি কোনোভাবে এই আগুনে নথিপত্র, প্রমাণ বা গুদামজাত পণ্য ধ্বংস হয়ে থাকে, তবে সেটা হতে পারে অর্থনৈতিক অপরাধ ঢাকার কৌশল।

আগেও দেশে এমন ঘটনা ঘটেছে—যেখানে সরকারি দপ্তরের ফাইল, রেকর্ড, এমনকি দুর্নীতির প্রমাণ আগুনে পুড়ে গেছে, এবং পরে ঘটনাটি “দুর্ঘটনা” বলে শেষ করা হয়েছে।
যদিও এখনো প্রমাণ মেলেনি, কিন্তু সম্ভাবনাটিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগও নেই।

কে লাভবান হতে পারে?
যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক অনুসন্ধান প্রশ্ন হলো—“কে এতে লাভবান?”
এই আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাষ্ট্র, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবসায়ীরা।
কিন্তু এর বিপরীতে কে লাভবান হতে পারে?

১. কেউ হয়তো রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিতে চাইছে।
২. কেউ হয়তো অর্থনৈতিক অনিয়ম ঢাকতে আগুন লাগিয়েছে।
৩. আবার আন্তর্জাতিক কোনো স্বার্থগোষ্ঠীও হয়তো চায়—বাংলাদেশে অনিশ্চয়তার আবহ ছড়িয়ে পড়ুক।

এসব প্রশ্নের উত্তর মিলবে কেবল স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমেই।

রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে কঠিন সময়
এই আগুনের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল, তা আবারও প্রকাশ্যে এসেছে।
শুধু বিমানবন্দর নয়—দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর, ও কৌশলগত স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা এখন পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক সিসিটিভি, সেন্সর ও ফায়ার অ্যালার্ম থাকা সত্ত্বেও যদি আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেখানে অভ্যন্তরীণ ত্রুটি বা স্যাবোটাজ (ধ্বংসাত্মক কাজ) ছাড়া অন্য কিছু কল্পনা করা কঠিন।

তদন্তই বলবে সত্য, কিন্তু…
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের এই অগ্নিকাণ্ড এখনো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। এরপর নিশ্চয় একটা তদন্ত কমিটি হবে। তবে সেই তদন্ত কমিটি কবে রিপোর্ট জমা দিবে, তা নিয়ে আছে প্রশ্ন।
সেই তদন্ত রিপোর্ট চোখ বন্ধ করে দেশের মানুষ মেনে নিবে, তাও না। কারণ আমাদের দেশে তদন্ত রিপোর্ট নিয়েও অনেক সময় তদন্তের দরকার হয়ে পড়ে।

এমন একটি সময়ে, যখন দেশ রাজনীতিকভাবে সংবেদনশীল, আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণের কেন্দ্রে, এবং প্রশাসনিকভাবে চাপে—তখন বিমানবন্দরে এমন অগ্নিকাণ্ড নিঃসন্দেহে শুধু দুর্ঘটনা নয়, বরং একটি সংকেত।
এ সংকেত হয়তো বলছে—রাষ্ট্রের ভেতরে ও বাইরে কেউ না কেউ পরিস্থিতি নড়বড়ে করতে চাইছে।

তদন্ত শুরু না হওয়া পর্যন্ত তা নিশ্চিত বলা যাবে না, তবে এতটুকু পরিষ্কার—এই আগুন শুধুই আগুন নয়, এর ভেতরে জ্বলছে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

You may also like

Leave a Comment