আলমগীর ইসলাম. ঢাকা:
সাম্প্রতিক একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে স্তম্ভিত সাধারণ মানুষ। মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে রাজধানী থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয়েছে ১০০ কোটিরও বেশি টাকার সম্পদ, প্রাণ হারিয়েছে শ্রমিক ও নিরাপত্তাকর্মীরা। আগুনের ধোঁয়া মিলিয়ে গেলেও রয়ে গেছে প্রশ্ন—এ কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি দেশের প্রশাসনিক অব্যবস্থা ও আইনের শিথিলতার এক ভয়ঙ্কর প্রতিচ্ছবি? সরকার বলছে, “তদন্ত চলছে, সত্য উদঘাটন হবে।” কিন্তু দেশের মানুষ সোচ্চার—“প্রতিবারই তদন্ত হয়, প্রতিবেদন হারিয়ে যায়; আগুনের মতোই প্রমাণও উড়ে যায় ধোঁয়ায়।”
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে অগ্নি নির্বাপণ ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, রাজউক, পরিবেশ অধিদপ্তর, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশনগুলোর ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠেছে।
ঘটনাগুলোর পর দেখা গেছে, অধিকাংশ স্থাপনাতেই দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণে অনিয়ম, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের অভাব এবং অবৈধ গুদাম পরিচালনা ছিল প্রকাশ্য গোপন তথ্য। কিন্তু এসব স্থাপনাগুলো বছরের পর বছর অনুমোদন ও নবায়নের আওতায় থেকেও কর্তৃপক্ষের নজরদারির বাইরে ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সংস্থার অবহেলা ও দুর্বল তদারকির কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে। অনেকে মনে করছেন, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক মদদের কারণে এসব স্থাপনাকে দীর্ঘদিন ধরে “অছোঁয়া” রাখা হয়েছে।
একজন সাবেক ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো জবাবদিহিতার আওতায় না আসে, ততদিন অগ্নিকাণ্ডকে ‘দুর্ঘটনা’ নয়, বরং ‘অব্যবস্থাপনার ফল’ বলাই সঠিক হবে।”
গেল কয়েকদি আগে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর এলাকায় ভয়াবহ আগুন লাগে একটি গার্মেন্টস কারখানায়, যা মুহূর্তেই পাশের রাসায়নিক গুদামে ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা আগুন নেভাতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নেন। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা চেষ্টার পর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে একাধিক ভবন ধসে পড়ে, নিহত হয় অন্তত ১৬ জন শ্রমিক।
ঐ ঘটনায় তদন্তকারীরা প্রাথমিকভাবে বলছেন, ভবনটির নিচতলায় রাসায়নিক দ্রব্য মজুত ছিল—যা আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, “এই এলাকায় রাসায়নিকের মজুত নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ আইন মানে না, কেউ তদারকি করে না।”
স্থানীয়দের মতে, ফায়ার সার্ভিস পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। অনেকেই বলেছেন—“শব্দে-শব্দে আগুন নয়, এই প্রশাসনই এখন আগুনে পরিণত হয়েছে।”
চট্টগ্রামের ইপিজেডে গুদামে আগুন — শিল্পনগরে আতঙ্ক:
চট্টগ্রামের রপ্তানিমুখী ইপিজেড এলাকায় আগুন লাগে এক বহুতল গুদামে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট কাজ করে প্রায় আট ঘণ্টা।
কারখানার উৎপাদন ইউনিট সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। অগ্নিকাণ্ডে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত কয়েক কোটি টাকার পণ্য পুড়ে ছাই হয়।
চট্টগ্রাম ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, “বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট হতে পারে।” কিন্তু শ্রমিকরা বলছেন, “এটি স্রেফ দুর্ঘটনা নয়, এ যেন পরিকল্পিত ধ্বংস।” তাদের অভিযোগ—ইপিজেডে নিরাপত্তা ব্যবস্থার নামেই শুধু আছে ফায়ার পোস্ট, কিন্তু কার্যত তা অনুপস্থিত।
ঐ ইপিজেডে কর্মরত শ্রমিক রাশেদুল হক বলেন, “দরজা বন্ধ ছিল, অ্যালার্ম বাজেনি, ভেতরে আটকা পড়েছিলাম। আমাদের জীবন এত সস্তা কেন?”
অপরদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন — রপ্তানির শৃঙ্খলে বিপর্যয়:
গেল শনিবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় আমদানি-রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ কনটেইনার, গুদাম ও পণ্য।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ফায়ার সার্ভিসের ১৩টি ইউনিট দীর্ঘ সাত ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শতাধিক আন্তর্জাতিক চালান।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, শুধু এ ঘটনাতেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হতে পারে। আগুনে পোশাক, স্যাম্পল, প্যাকেটিং উপকরণ এবং রপ্তানির গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টও পুড়ে যায়।
বিজিএমইএ এর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “আমাদের রপ্তানি কার্যক্রম এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেছে। বিদেশি ক্রেতারা ইতোমধ্যে বিকল্প সরবরাহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন।” এখন আশঙ্কা—বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত আবারও আন্তর্জাতিক আস্থার সংকটে পড়তে পারে।
এসব ঘটনার পর দেশজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন— “প্রতিদিনই আগুন, কোথাও রাসায়নিক, কোথাও বিমানবন্দর—এ কি কাকতালীয়?”
অনেকেই মনে করছেন, দেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে “অদৃশ্য নাশকতা” সক্রিয় হচ্ছে। আবার কেউ কেউ এটিকে সরকারের ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখছেন।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন- এই ধারাবাহিক আগুনের ঘটনা প্রশাসনিক দুর্বলতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অক্ষমতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি। জনগণ আর সরকারকে বিশ্বাস করছে না।
সরকারের বক্তব্য: “তদন্ত চলছে, কেউ ছাড় পাবে না” প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরই পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “যদি প্রমাণ পাওয়া যায় এটি নাশকতা, তাহলে আমরা কাউকে ছাড় দেব না। প্রশাসন সব সময় সতর্ক অবস্থায় আছে।”
কিন্তু জনগণের প্রশ্ন—“তদন্ত হয়, রিপোর্ট কোথায় যায়?” বিগত পাঁচ বছরের আগুনের ঘটনাগুলোর কোনো প্রতিবেদনই জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়নি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপারগতা—ব্যবস্থার চেয়ে ‘বিবৃতি’ বড়। প্রতিটি ঘটনার সময়ই দেখা গেছে—আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে বিলম্ব, পানির অভাব, রাস্তা দখল, আর উদ্ধার তৎপরতার সমন্বয়হীনতা।
একজন দমকল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের সরঞ্জাম পুরনো, রাস্তা সরু, প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া অনেক জায়গায় ঢোকাই যায় না। আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি, কিন্তু কাঠামোগত দুর্বলতা আমাদের আটকে দেয়।”
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি স্পষ্ট। যেখানে উন্নত দেশে এক ক্লিকে কাজ হয়, সেখানে আমাদের দেশে এক ফাইল ঘুরে তিনদিন সময় লাগে।
নাশকতার গন্ধ নাকি প্রশাসনিক ব্যর্থতা?
বর্তমান সময়ে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিভিন্ন আন্দোলন ও সামাজিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে একটি উদ্বেগজনক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সময়ের ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডকে নিছক কাকতালীয় বলা যায় না।
অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক প্রভাব: তিনটি ঘটনায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার বেশি, বলে জানিয়েছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
শুধু গার্মেন্টস খাতেই ক্ষতি শত শত কোটি টাকার। রপ্তানি বিলম্বিত হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ চেয়েছে এবং “রপ্তানি ক্ষতি ফান্ড” গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, রপ্তানি বিলম্বে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ সাময়িকভাবে কমে যেতে পারে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আগুনের ঘটনাকে নাশকতা না বলে অবহেলা বলা যায়। তারা মনে করেন—শিল্প এলাকায় ফায়ার কোড প্রয়োগে ব্যর্থতা, অদক্ষ ফায়ার সেফটি, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
“বাংলাদেশে আগুন এখন আর দুর্ভাগ্য নয়—এটি প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতীক,” বলেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
আগুন নেভে, কিন্তু দায়ের আগুন নেভে না:
প্রতিবারের মতো এবারও তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলছে—এই তদন্তের ফলাফলও হয়তো ফাইলবন্দি হয়ে যাবে।
যেখানে দোষীরা কখনও শাস্তি পায় না, সেখানেই নতুন আগুন লাগার সুযোগ বাড়ে।
অগ্নিকাণ্ডের পর এক নাগরিক ক্ষোভভরে বলেন, “আমরা এখন জানি—আগুনের পরও আগুন লাগবে। কারণ, এখানে দায়ের আগুন কেউ নেভায় না।”
আগুন শুধু পুড়ছে না—পুড়ছে আস্থা, পুড়ছে নিরাপত্তা। এই আগুনের ছাইয়ের নিচে লুকিয়ে আছে এক বৃহৎ বাস্তবতা—বাংলাদেশে নিরাপত্তা মানে এখন শুধু বিবৃতি, বাস্তব নয়। সরকার, প্রশাসন ও ব্যবসায়িক সংগঠন—সবাই বলছে, “তদন্ত হবে”, কিন্তু মানুষ বলছে, “বিশ্বাস হারিয়েছি।”
যদি এই আগুনগুলোর প্রকৃত কারণ উদঘাটন না হয়, দায়ীরা জবাবদিহির আওতায় না আসে, তবে একদিন বাংলাদেশের শিল্প ও নাগরিক নিরাপত্তা পুরোপুরি ভস্মীভূত হবে। এখন প্রশ্ন—কবে আমরা আগুন নেভাবো, আর কবে নিজেদের দায়িত্ব?
আগুন নেভাতে হলে আগে প্রশাসনের উদাসীনতা নেভাতে হবে—তবেই বাঁচবে মানুষ, বাঁচবে বাংলাদেশ।”
সরকারিভাবে বলা হয়েছে—“যদি কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মেলে যে আগুন ছিল সজ্ঞানে লাগানো বা অগ্নিসংযোগ, তাহলে দ্রুত ও দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তাই বলা যায় — দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র (সাবোটাজ)-এর বিষয়টি এখনো স্পষ্টভাবে নিশ্চিত হয়নি, তবে তদন্তের পর্যায়ে “সাবোটাজ” বা ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগের সম্ভাবনাও বাদ দেওয়া হয়নি।
